১৫ আষাঢ় ১৪৩১
 

সর্বশেষ

ইছামতি নদীর ৬০ ভাগ বেদখল ৩ দশকেও খননের দাবি পূরণ হয়নি

Aug 1, 2015, 10:13:54 PM

ইছামতি নদীর ৬০ ভাগ বেদখল ৩ দশকেও খননের দাবি পূরণ হয়নি

পাবনার মূল ইছামতি নদীর ৬০ ভাগই অবৈধ দখলদারদের কবলে। ফলে পাবনাবাসীর এক সময়ের আশীর্বাদ এ নদী এখন হয়েছে দুঃসহ অস্বস্তিকর, যেন তা শেষ হওয়ার নয়। পাবনা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৪০০ বছরের পুরনো ইছামতি নদী প্রায় দুই লাখ শহরবাসীর ব্যবহৃত পানি ও বর্জ্য মিশে একাকার হয়ে এক দুর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। পাবনা পৌরবাসীর এখন একটাই প্রধান দাবি ইছামতি নদী খনন করে এর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁর শাসনামলে ১৬০৮-১৬১৬ সৈন্য পরিচালনার সুবিধার্থে পাবনা শহরের ভেতর দিয়ে (তখন শহর ছিল না) পদ্মা ও যমুনা নদীর সংযোগ স্থাপনার্থে একটি খাল খনন করেন। এই খালই পরে ইছামতি নাম ধারণ করে। ১৮৮১ থেকে ১৮৯১ সালের মধ্যে পদ্মা ১০ মাইল পশ্চিম দিক থেকে শুরু করে পূর্ব দিকে উত্তর মুখে বাঁক নেয়। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও নদীর অর্ধেক এখন নর্দমা। পৌর এলাকার মধ্যে এর প্রায় আট কিলোমিটার। নদীর প্রশস্ততা ছিল ৯০-২০০ ফুট, বর্তমানে তা আছে ২০-৪০ ফুট। সংস্কার করা হয় না প্রায় ৩০ বছর। বর্তমানে উৎস মুখের কাছে (বাংলা বাজারে স্লুইস গেট) ভরাট করে ফেলায় এ নদী হয়ে পড়েছে প্রাণহীন বদ্ধ খাল। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ নদীতে প্রবাহ ছিল।
২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় ইছামতি নদীর দুই পাড়ে অনেক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নদীর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, পাবনা জেলার প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি নদীর ভূমি ১৯২০-১৯২২ সালের ডিএস/সিএস, পরবর্তী ১৯৪৫-১৯৫২ সালের দিয়ারা/১৯৫৮-১৯৬২ সালে এসএ জরিপ হয়। সর্বশেষ ১৯৭৬-১৯৮৫ সালে প্রকাশিত আরএস জরিপের ভিত্তিতে নদীর আয়তন ২৪.৯০ একরে দাঁড়িয়েছে। অথচ মূল এসএ রেকর্ডে ছিল ৮৩.৪৩ একর। সংশ্লিষ্ট বিভাগের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, জরিপ বিভাগ অবৈধ যোগসাজশ করে এসএ এবং আরএস জরিপে ইছামতি নদীর উভয় পাড়ের বিপুল জমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে দিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে নদী সংস্কার না করায় ক্রমাগত উভয় পাশের জমির মালিকেরা অবৈধ এসএ/আরএস রেকর্ডের ভিত্তিতে নিজ নিজ নামে ইছামতির অভ্যন্তরের জমির মালিকানা দাবি ও দখল করায় ইছামতি প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। 
পাবনা জেলা প্রশাসনের তথ্যে আরো জানা যায়, ডিএস অনুসারে নদীর সর্বনি¤œ প্রস্থ ছিল ২২৫ থেকে ১৪০ ফুট। অথচ সর্বশেষ আরএস রেকর্ডে তা ১১০ থেকে ১১৫ ফুটে নেমে এসেছে। রিপোর্টে সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে এসএ এবং আরএস রেকর্ড অনুসারে গোপালপুর ও দণি রাঘবপুর মৌজার অংশে নদীর কোনো চিহ্ন নেই। এ দুইটি মৌজার সবই অবৈধ দখলদাররা ঘরবাড়ি বানিয়ে দখল করে নিয়েছে। 
ইছামতি নদী পাবনার উত্তর প্রান্ত দিয়ে পূর্বে আতইকুলার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেছে। সাঁথিয়া সদরের পাশ দিয়ে বেড়া সদরের বৃ-শালিখা এলাকার হুরাসাগর নদীতে গিয়ে মিশে যমুনায় পড়েছে। বেড়ার কাছেও ইছামতির প্রান্তখাত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৯৭৮ সালে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করার সময় ইছামতির সাথে বড়াল নদীর সংযোগ মুখে নির্মিত হয় স্লুইস গেট। বেড়া থেকে আতাইকুলা পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হয়। বেড়া পাম্প হাউজের সাহায্যে পানি পাম্প করে এই নদীর পেট ভরে পানি রাখা হচ্ছে সেচ কাজের জন্য। কিন্তু অবশিষ্ট ২০ কিলোমিটার নদী ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শহরের নর্দমাগুলোর চেয়ে ইছামতির তলদেশ উঁচু হয়ে উঠেছে। দখল হয়ে গেছে নদীর কিনারা।
পাবনা শহরবাসী ইছামতি নদীকে নর্দমার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। আগে আবর্জনার পরিমাণ ছিল সহনীয়। তার ওপর ছিল প্রবাহ। এখন তা নেই। বার বার এ নদী খননের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা মাঝপথে থেমে যায়। 
বর্তমানে এই নদী পাবনাবাসীর মারণ ফাঁদে পরিণত হওয়ায় ইছামতি পুনঃখনন করা এবং শহরাংশে নদীর দুই পাড় বেঁধে রাস্তা ও ফুটপাথ নির্মাণসহ পানির প্রবাহ সচল রাখা ও দুই পাড়ে বৃরোপণসহ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন পাবনাবাসী। আর এ ল্েয পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালে ১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও তা ফাইলবন্দী অবস্থায় পড়ে থাকে। পরে আংশিকভাবে একই বছর (২০০৫ সালে) মূল শহরের বাইরে শালগাড়িয়া থেকে মাছিমপুর প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার নদী এনজিও ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ খনন করে। এ ছাড়া শহরের মধ্যে কচুরিপানা পরিষ্কার করে। এ জন্য ব্যয় হয় প্রায় ৪০ লাখ টাকা। এর পর আর কাজ হয়নি।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আট কিলোমিটার নদী খননের জন্য ‘ইছামতি নদী সংস্কার, পুনঃখনন ও ব্যবহার উপযোগীকরণ’ নামে প্রায় ২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় দুই কোটি টাকা বরাদ্দ করে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে খনন এবং নদী থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হয়। পাবনা পৌরসভা ও জেলা পরিষদ এবং এলজিইডি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বয়ে এই কাজ করা হয়। এরপর বর্তমান সরকার মতায় এলে এই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। 
সর্বশেষ আমেরিকা প্রবাসী পাবনার এক কৃতী সন্তান মোস্তাক আহমেদ কিরণের সহায়তায় পাবনা পৌরসভা প্রায় শত কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করছে বলে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী তবিবুর রহমান জানান। আন্তর্জাতিক কোনো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা দাতা সংস্থার সমর্থনে এ কাজ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে টাকার কোনো সমস্যা হবে না বলে নির্বাহী প্রকৌশলী জানান। এ ব্যাপারে তিনি নদীবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানকে এ প্রকল্পের সাথে যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ব্যাপারে মোস্তাক আহমেদ কিরণের উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাবনার সুধীমহলকে নিয়ে একটি সেমিনার করা হয়। সেখানে প্রজেক্টের মাধ্যমে নদীকে সংস্কার, খনন ও তাকে কেন্দ্র করে আধুনিক শহর তৈরি করার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। পৌর মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু জানান, নতুনভাবে ইছামতি খননের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ পাবে বলে দাবি করে তিনি বলেন, নদীটি আগের প্রবাহ ফিরে না পেলেও শহরবাসী এ নদীকে ঘিরে অপরূপ সৌন্দর্য বিনোদনের পরিবেশ পাবে। 

 
 
 
পাবনা নিউজ২৪.কম
থানাপাড়া (হেলেন কটেজ), পাবনা-৬৬০০
ই-মেইলঃ newsroom@pabnanews24.com