১৩ আষাঢ় ১৪৩১
 

সর্বশেষ

পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ

Aug 7, 2015, 7:25:54 PM

পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার মাঝ পদ্মা নদীর উপর নির্মিত ব্রিজটি। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ৪ মার্চ ১৯১৫ সালে এটি উদ্বোধন করেন। তার নামনুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।

ব্রিটিশ সরকার ভারত উপমহাদেশের রেল যোগাযোগের ব্যাপকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১২৬ বছর আগে ১৮৮৯ সালে পদ্মা নদীর ওপর রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। বিশেষ করে ভারতের দার্জ্জিলিং ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে যাতায়াতের সুবিধার্থে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার সীমারেখা পদ্মা নদীর ওপর ব্রীজ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করে।

১৯১০ সালের আগে শ্রমিক সংখ্যা কম থাকলেও ১ ফেব্রুয়ারী ১৯১০ থেকে প্রকল্পটিতে কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। তখন থেকে ২৪ হাজার ৪ শত শ্রমিক যারা দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৪ সালের শেষের দিকে ব্রীজটির কাজ শেষ করে। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারী পরীক্ষামূলক ভাবে ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম মালগাড়ি ( ট্রেন) চালানো হয়। ২ মাস পর ৪ মার্চ ডবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহি ট্রেন চলাচল শুরু করে। সে সময় ব্রীজটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। তার নামানুসার ব্রীজটির নামকরণ হয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রীজ।

ব্রীজটি নির্মাণে কূপ খনন করা হয়, বসানো হয় ১৫টি স্প্যান, যার প্রতিটি বিয়ারিং টু বিয়ারিং এর দৈর্ঘ্য ৩শ ৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২শ ৫০ টন। রেল লাইনসহ ১ হাজার ৩শ টন, এছাড়াও দু’পাশে ল্যান্ড স্প্যান রয়েছে যার দুরত্ব ৭৫ ফুট। ব্রীজটির মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮শ ৯৪ ফুট (১ মাইলের কিছু বেশি)। ব্রীজ নির্মাণে মোট ইটের গাথুনি ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ইস্পাত ৩০ লাখ টন, সাধারণ সিমেন্ট ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম এবং কিলডসিমেন্ট (বিশেষ আঠাযুক্ত) লাগানো হয় ১২ লাখ ড্রাম।

হার্ডিঞ্জ ব্রীজের ১ হাজার গজ ভাটি থেকে ৬ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত ১৬ কোটি ঘন ফুট মাটি ও ২ কোটি ৩৩ লাখ ৭০ হাজার ঘনফুট পাথর ব্যবহার করে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৩ কিলোমিটার প্রস্থ নদীর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা- পাবনার পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রীজ নির্মাণ স্থলে দু’পাশে বাঁধ দিয়ে ১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার নদী সংকুচিত করা হয় এবং হার্ডিঞ্জ ব্রীজ নির্মাণের সময় ব্রীজটির অ্যালাইনমেন্টে নদীর পানির বহন ক্ষমতা দাড়ায় ২৫ লাখ ঘনফুট।

তখনকার সময় ব্রীজটি তৈরীতে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১শ ৬৪ টাকা। এর মধ্যে স্প্যানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার ৭শ ৯৬ টাকা, ল্যান্ড স্প্যানের জন্য ৫ লাখ ১৯ হাজার ৮শ ৪৯ টাকা, নদীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩শ ৪৬ টাকা ও দুই পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১শ ৭৩ টাকা।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ব্রীটিশ সরকারের নির্মিত ব্রীজটির খ্যাতি বিশাল পরিচয় বহন করে। বর্তমান জগতে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের চেয়েও লম্বা অনেক আছে। কিন্তু কিছু কিছু কারণে এ ব্রীজটি অপ্রতিদ্বন্দীভাবে বিখ্যাত। প্রথম কারণ হচ্ছে এ ব্রীজের ভিত গভীরতম পানির সর্বনিম্ন সীমা থেকে ১৬০ ফুট বা ১৯২ এমএসএল মাটির নিচে। এর মধ্যে ১৫ নম্বর স্তম্ভের কুয়া স্থাপিত হয়েছে পানি নিম্নসীমা থেকে ১শ ৫৯ দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১শ ৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থ্যাৎ সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১শ ৪০ ফুট নীচে। সে সময় পৃথীবিতে এ ধরনের ভিত্তির মধ্যেই এটাই ছিল গভিরতম। ব্রীজটি অপূর্ব সুন্দর ও আর্কষণীয় হওয়াতে ব্রিটিশ ইনচীফ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস’কে সাফল্যের পুরস্কারস্বরূপ স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সূত্র আরো জানায়,তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১০০ বছরের গ্যারেন্টি দিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে ব্রীজটির কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটবেনা। সে অনুযায়ী আসলেই তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেওনি।
১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে পাকিস্তানি হানাদাররা ব্রিজটির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। পাক বাহিনী ব্রীজটির ওপর বোমা বর্ষণ করে। এর ফলে পিলারের ওপর থেকে ৯ নং স্প্যান (গাডার)টির এক প্রান্ত নদীর মাঝে পড়ে যায়। ১৫ নং স্প্যানটির নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর যে বোমা দ্বারা ব্রীজের ক্ষতিসাধন করা হয় তা এখনো পাকশীস্থ বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজারের কার্যালয় সামনে সংরক্ষিত রয়েছে।

পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ও ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ব্রিজের স্প্যানের উদ্ধার ও মেরামত করে রেলগাড়ি চলাচলের উপযোগি করে তোলা হয়। মেরামত করে ভারতের পূর্ব রেলওয়ে শ্রী এইচকে ব্যানার্জী, চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী আরকে এসকে সিংহ রায়, ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার, শ্রী পিসিজি মাঝি, এ্যাসিসন্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার এছাড়াও বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে ছিলেন রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ আলী, ইঞ্জিনিয়ার ইন চীফ ইমাম উদ্দিন আহমেদ, ডিভিশনাল সুপার এম রহমান প্রমূখ।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করা হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি ও এর আশেপাশের নয়নাভিরাম অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেশের দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুে আসে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশে নিয়মিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লালন শাহ সেতু আর পদ্মার দু’পাড়ের সবুজে ঘেরা মনোরম সৌন্দর্য্য বিনোদন প্রেমীদের কাছে নতুন মাত্রা আনে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘিরে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে রিসোর্ট, পিকনিক স্পট। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে দর্শনার্থীদের কেন্দ্র করে দোকান সাজিয়ে বসেছে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ও বিশেষ দিনে পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোরসহ দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই স্থানটি দেশের পর্যটনের দিক দিয়ে সম্ভাবনাময় অবদান বয়ে আনতে পারে।

এশিয়ার বৃহত্তম রেলসেতু ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সেতু বন্ধন ২০১৫ সালে শতবর্ষে পদার্পণ করছে। ইতিহাসের সাক্ষী পাবনা জেলার সাড়া থানার (সাড়া থানা বিলুপ্ত করে করা হয় ঈশ্বদী থানা) পাকশীতে পদ্মা নদী বক্ষে আজো দাড়িয়ে আছে। যা ঘিরে ঈশ্বরদীর পাকশী দেশের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। এই ব্রীজ ইতিমধ্যেই ভূগোল-ইতিহাস-সাধারণ জ্ঞানের পাঠ্য পুস্তকের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। 

 
 
 
পাবনা নিউজ২৪.কম
থানাপাড়া (হেলেন কটেজ), পাবনা-৬৬০০
ই-মেইলঃ newsroom@pabnanews24.com