১৩ আষাঢ় ১৪৩১
 

সর্বশেষ

মানুষকে ছায়া দেওয়াই যাঁর নেশা

Sep 9, 2015, 10:45:28 PM

মানুষকে ছায়া দেওয়াই যাঁর নেশা

সামান্য দর্জির কাজ করেন তিনি। ওই আয় দিয়ে দুমুঠো খেয়ে-পড়ে চলাই দুস্কর। কিন্তু ওই সামান্য আয় দিয়েই তিনি হাজার হাজার মানুষকে শীতল ছায়া দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে রাস্তার দুই পাশে ও ফাঁকা স্থানে বটগাছ রোপণ করছেন তিনি। তবে অন্য গাছও রোপণ করেছেন।

বটবৃক্ষপ্রেমী ওই ব্যক্তির নাম ইদ্রিস আলী খান। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সবাই তাঁকে গাছপাগল হিসেবে চেনেন। গাছের প্রতি এই ভালোবাসার জন্য পাবনা জেলা প্রশাসন ২০০৮ সালে তাঁকে সাদা মনের মানুষ হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ইদ্রিস আলী খানের বাড়ি পাবনার ফরিদপুর উপজেলার চিথুলিয়া পূর্বপাড়ায়। মাত্র চার বছর বয়সে বাবা বাদশা খানকে হারান। এরপর বড় ভাইদের সংসারে বড় হন। ১৯৭৫ সালে দেন এসএসসি পরীক্ষা। কিন্তু অকৃতকার্য হন। এরপর আর লেখাপড়া করেননি। তবে উচ্ছন্নে যাননি। বাড়ির আশপাশেসহ বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগানো শুরু করেন। তবে বটগাছ লাগানোর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয় আরো কয়েক বছর পর।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ইদ্রিস আলী খানের সঙ্গে। বললেন, ‘প্রায় ২৫ বছর আগে বাড়ির পাশে বড়বিলার মধ্যে বিশাল বটগাছটি ঝড়ে ভেঙে যায়। এতে খুব মন খারাপ হয়। এলাকাটি গাছশূন্য ন্যাড়া ন্যাড়া মনে হয়। তাই ভাবি সেখানে একটি বটগাছ লাগানো দরকার। গাছ লাগিয়ে দিলাম। খুব ভালো লাগল। এরপর দেখি গ্রামের ঈদগাহ মাঠের পাশে খালি জায়গা। সেখানেও একটি বটগাছের চারা লাগালাম। একদিন ফরিদপুর উপজেলা চত্বরে ঢুকতেই জায়গা দেখে খালি খালি লাগল। সেখানে চারা লাগালাম। এভাবেই শুরু বটগাছ লাগানো। প্রতিটি গাছ লাগানোর পর ভাবি আর গাছ লাগাব না। কিন্তু পছন্দমতো জায়গা দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত বটের চারা না লাগাতে পারি ততক্ষণ শান্তি পাই না। তখন থেকে মনের শান্তির জন্য বটের চারা লাগাই।’

বটবৃক্ষের ছায়া যেমন, মায়ের স্নেহ লাগে তেমন বটগাছের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টির বছর খানেকের মধ্যে ইদ্রিস আলীর মায়ের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, ‘আমার মা মারা যাওয়ার পর একদিন রেডিওতে গান শুনি। গানটি ছিল এমন ‘‘বটবৃক্ষের ছায়া যেমন, মায়ের স্নেহ লাগে তেমন’’ এ গান শুনে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। সেখান থেকেও বটগাছ লাগানোর অনুপ্রেরণা পাই। এখনো বটগাছ দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।’

এরপর শুরু হয় ইদ্রিস আলীর বটবৃক্ষ রোপণ অভিযান। ফরিদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, কবরস্থান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, সরকারি কার্যালয়, হাট-বাজার, বিভিন্ন রাস্তার মোড়, ঈদগাহ মাঠ ও সরকারি খালি জায়গায় যেখানে সুবিধা পেয়েছেন সেখানেই গাছ লাগানো শুরু করেন। এ পর্যন্ত তিন শতাধিক বটগাছ লাগিয়েছেন তিনি।

পুরো ফরিদপুর যেন বটবৃক্ষপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ফরিদপুর উপজেলা, চাটমোহর-বাঘাবাড়ী বিশ্বরোডের দুই পাশ, বড়াল নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নিজ গ্রাম চিথুলিয়া, সোনাহারা ত্রিমোহনী মোড়, ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন, বন্যাকান্দি খেয়াঘাট, বেড়হাউলিয়া ঈদগাহ, শিববাড়ী, নাদোবাড়ী, ঘোড়াচক, পার-ফরিদুপর, ডেবক, মাটকুড়া, কাশিপুর, হাদল মাদ্রাসা,সাভার, দীঘিরভিটা, জলসেবিটা, কাটাতলা, জলিশাভিটা, নেছড়াপাড়া বাজার, বনওয়ারীনগর বাজার, খলিশাদহ সোনার বাংলা ক্লাব, ডেমরা স্লুইস গেট, খাগরবাড়িয়া, ভদ্রনামি, বিলবকরি, শিরবাড়ী, হাটগ্রাম সোনালী সৈকতসহ আরো অনেক জায়গায় বট-পাকুর গাছের চারা লাগিয়েছেন ইদ্রিস আলী। ইদ্রিস আলীর লাগানো বটগাছগুলো এখন মানুষের নজর কাড়ছে। পরম মমতায় তিনি ওই গাছগুলো লাগিয়েছেন, বড় করছেন।

ইদ্রিস আলী দূর-দূরান্ত থেকে বটের চারা সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া পুরনো ভবন, তালগাছের মাথা এবং কারও কারও বাড়ি থেকেও চারা সংগ্রহ করেন। চারা লাগানোর পর বাঁশের বেড়া দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে দেন। চারার গোড়ায় মাটি দেন। এর পর একনাগাড়ে সাত দিন চারায় পানি দিয়ে আসেন।

বটগাছের প্রতি ভালোবাসার কারণ ইদ্রিস আলীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম বটগাছের প্রতি ভালোবাসার কারণ। বললেন, ‘ফলের গাছ রাস্তায় লাগালে বিবাদ দেখা দিতে পারে। মানুষের জায়গায় ফলের গাছ লাগানো ঝামেলার ব্যাপার। তা ছাড়া ফলের গাছ বড় হলে মরে যায়। বটগাছ অনেক দিন বাঁচে। বটগাছের ডালপালা মানুষকে অনেক বেশি শীতল ছায়া দেয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বটগাছ বেশি ভালো। আমাদের দেশে এক সময় অনেক বটগাছ ছিল। তাই বটগাছ লাগালে আমি আলাদা শান্তি পাই, যা অন্য গাছে পাই না।’

নাম তাঁর গাছপাগল ইদ্রিসের লাগানো দেওভোগ বটতলায় বিশ্রাম নেওয়ার সময় কথা হয় বনওয়ারীনগর গ্রামের ইছুব আলী মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গাছ পাগল ইদ্রিস আলীকে সবাই এক নামেই চেনে। গাছ ছাড়া তিনি যেন কিছুই বোঝেন না। বিয়ে সাদী কিছুই করল না। গাছই তার ছেলেমেয়ে।’

পার-ফরিদপুর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, ‘শুধু আমাদের এখানেই নয়, বটগাছ পাগল ইদ্রিস বহু জায়গায় গাছ লাগায়। আমরা তাঁকে গাছ পাগল বলেই চিনি। সারা জীবন তিনি এভাবেই কাটিয়ে দিচ্ছেন।’

ইদ্রিস থাকেন জীর্ণ ঘরে ইদ্রিসের লাগানো গাছের তলায় হাজার হাজার মানুষ বিশ্রাম নেন। অনুভব করেন প্রশান্তি। আর ইদ্রিস? তিনি থাকেন চিথুলিয়া পূর্বপাড়ায় জীর্ণ-শীর্ণ কুটিরে। একা। গাছের প্রতি ভালোবাসায় বিয়েও করেননি। রোপণ করা সব গাছ নিয়েই তাঁর সংসার। নতুন নতুন গাছ লাগানোর পাশাপাশি ওই সব গাছের নিয়মিত যত্ম করেন তিনি।

ইদ্রিস আলী খান জানান, একটা গাছ লাগানোর জন্য তাঁর গড়ে ৩০০ টাকা খরচ হয়। ফরিদপুর বাজারে এক সময় জলিল মোল্লার দর্জির দোকানে কাজ করতেন। দিনে ১৫০-২০০ টাকা আয় হতো। কিন্তু বর্তমানে শুধু সপ্তাহে দুই দিন শুক্র ও মঙ্গলবার হাটের দিন কাজ করেন। আয় কমে গেলেও প্রায় সব টাকাই খরচ করেন গাছের পেছনে। তাঁর দুঃখ, টাকার অভাবে অনেক জায়গায় গাছ লাগাতে পারেননি।

ইদ্রিস আলী বট-পাকুর গাছের পাশাপাশি তাল, খেজুর, আম, জাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, বকুল ফুলের গাছ লাগান। ডাক পেলেই অন্যের বাড়িতে গাছের কলম বেঁধে দেন।

আসুন, গাছ লাগাই ফরিদপুর মুক্ত মঞ্চের সামনে ইদ্রিসের হাতে লাগানো বট-পাকুর গাছের ছায়ায় বসে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। ইদ্রিস বললেন, ‘সিডরে সুন্দরবনে গাছপালার প্রচুর ক্ষতির খবরে খুব কষ্ট পেয়েছি। আমার সামর্থ্য থাকলে সুন্দরবনে গাছ লাগাতাম।’

ইদ্রিস বলেন, ‘গাছ লাগানোর সময় অনেক জায়গায় বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি। তাদের গাছের সুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে গাছ লাগিয়েছি। এখন তারা সুফল পাচ্ছে। আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নাই। তবে গাছের ডালপালা যেন কেউ না কাটে।’ সবার কাছে তিনি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আসুন সবাই গাছ লাগাই, পরিবেশ বাঁচাই। 

 
 
 
পাবনা নিউজ২৪.কম
থানাপাড়া (হেলেন কটেজ), পাবনা-৬৬০০
ই-মেইলঃ newsroom@pabnanews24.com