Oct 3, 2015, 1:18:31 PM
স্বনামে খ্যাত সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও রাজনীতিবিদ রণৈশ মৈত্র তাদেরই মধ্যে একজন-যারা আজীবন শোষিত, নিপিরিত ও নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ে নিজেকে বিলিয়ে দেন। যার জীবন ও যৌবনের সবচেয়ে সোনালী দিন গুলো কেটেছে জেলখানায়। মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ মানুষের ক্রন্তিলগ্নে তিনি সবসময় সাহসি সৈনিকের ভুমিকা পালন করেছেন।
প্রগতিশীল ও অসম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার এই মানুষটি জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৩৩ সালের ৪ঠা অক্টোবর তাঁর মাতামহের চাকুরীস্থল রাজশাহী জেলার ন’হাটা গ্রামে। তার বাবা রমেশ চন্দ্র ছিলেন পাবনার আতাইকুলা থানার ভুলবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন আদর্শ শিক্ষক। সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র বাবার ব্যক্তি সততার কারণেই চরম দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি তার শৈশবকাল অতিবাহিত করেন। সপ্তম শ্রেণীতে উঠার পর থেকেই তিনি টিউশনী করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। নিজ জীবন সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়েই রণেশ মৈত্র দেশের অসহায় , শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। ১৯৫০ সালে পাবনার জিসিআই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আই এ এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়ে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়েই শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন পাবনা জেলার অন্যতম সংগঠক। সেই বছরেই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে তিনি অবজারভারের আব্দুল মতিন, কামাল লোহানী সহ প্রগতিশীল বন্ধুদের সাথে গঠন করেন শিখা সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। যে সংগঠনের একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল সেখান থেকে শিখা নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশিত হত। ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন সহ পাক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তিনি বহুবার কারা বরণ করেছেন। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে ন্যাপে যোগ দেন। পরে ১৯৬৭’র দিকে তিনি মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন রুশপন্থী ন্যাপে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন ন্যাপের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তৎকালীন পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান জেলার প্রগতিশীল বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিরও রনেশ মৈত্র ছিলেন একজন অন্যতম সদস্য। ১৯৯৩ সালে তিনি ড. কামাল হোসেনের সাথে গণফোরামে যোগ দেন । তিনি দীর্ঘদিন গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে২০১৩ সালে ঐক্য ন্যাপে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঐক্য ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
১৯৫১ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নও বেলাল পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার সাংবাদিতা জীবন শুরু হয়। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে তিন বছর সাংবাদিকতার পর ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং নিউজ এবং ১৯৬৭ সাল থেকে তিনি ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দৈনিক অবজারভারে পাবনা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে দি নিউ নেশনের মফস্বল সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়ার পর ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি দি ডেইলী স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরে তিনি স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে একজন ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্র পত্রিকায় কলাম লিখে সারা দেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন।
এ ছাড়া ১৯৬১ সালে পাবনায় পূর্ব পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত পুর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকরা তাদের পেশার স্বীকৃতি পায়। তিনি সেই বছরেই প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এছাড়া তিনি দীর্ঘদিন পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে জেলার সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সফল আইনজীবী হিসেবেও দীর্ঘদিন তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পরে আইন পেশা থেকেও স্বেচ্ছায় অবসর নেন।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ রুদ্র চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ পাঠক মহলে সমাদ্রিত হয়েছে। তার সাতাত্তুর তম জন্ম দিনে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থ : নি:শঙ্ক পথিক রণেশ মৈত্র-তার জীবনের উপর বিভিন্ন জনের এক বর্ণিল চিত্রগাঁথা।
এত স্বল্প পরিসরে রণেশ মৈত্রের জীবনকে তুলে ধরা সম্ভব নয়। রণেশ মৈত্রকে আমি কাকা বলে ডাকি। আমার আব্বা প্রয়াত মীর্জা শামসুল ইসলামের সবচেয়ে ঘনিষ্ট দুই বন্ধুর একজন ছিলেন রনেশ মৈত্র । আর অপরজন ছিলেন আনোয়ারুল হক। বয়সে দুজনই আব্বার সিনিয়র হলেও বন্ধুত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে সেই ব্যবধানটুকু খোথায় যেন হারিয়ে যায়। আব্বাকে দেখতাম এ দুজনের য কোন সংকটে নিজেও সবসময় চিন্তাগ্রস্থ থাকতেন। প্রায় প্রতিদিনই টেলিফোণে ঘন্টান পর ঘন্টা কথা হচ্ছে। এই সুত্রেই মুলত তাদেও মধ্যে আমি নিজেও আমার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখি।
আজ ৪ অক্টোবর আমার প্রিয় রণেশ কাকার ৮২ তম জন্মদিন। আমি আন্তরিকভাবে কামনা করি মহান ঈশ্বর যেন আরো অনেক দিন তাকে সুস্থ্য আর সবলভাবে বাচিয়ে রাখেন।
লেখকঃ উৎপল মির্জা
উত্তরাঞ্চলীয় ব্যুারো চীফ মাছরাঙা টেলিভিশন ,পাবনা।