১৭ আষাঢ় ১৪৩১
 

সর্বশেষ

কুমড়োর বড়িতে আধারপাড়ায় সচ্ছলতার আলো

Nov 10, 2013, 11:33:21 AM

কুমড়োর বড়িতে আধারপাড়ায় সচ্ছলতার আলো

কাজী বাবলা: পাবনার একটি অজপাড়াগাঁয়ে কুমড়ো বড়ি বিক্রি করে ৫০টি পরিবার ফিরিয়ে এনেছে সংসারে সচ্ছলতা। শীতের শুরুতেই তৈরি করা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু এই তরকারিটি চাটমোহরের আধাপাড়ার মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়। পাড়াটি এলাকাবাসীর কাছে কুমড়ো বড়ির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। বছরের সাত মাস এ ব্যবসার সঙ্গে ৫০টি পরিবার জড়িত। গ্রামটির নাম আধারপাড়া হলেও  মানুষগুলোর কর্মক্ষমতায় এসেছে পরিবারগুলোতে সচ্ছলতার আলো। অনেক পরিবার জমি কিনে নতুন টিনের ঘর তুলে বাড়ি করেছে। যদিও বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি গ্রামবাসীর ঘরে ঘরে।


আধারপাড়া গ্রামের যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই শুধু কুমড়ো বড়ির চাতাল। শীতকালীন এই তরকারিটি বাণিজ্যিকভাবে খুবই জনপ্রিয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বড়ি চলে যায় ঢাকাসহ উত্তরের সব জেলায়। আর এই বড়ি বিক্রি করে গ্রামটির হতদরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সংসারের দারিদ্র্য মোচন করছে।

হেমন্তের শিউলি ঝরা এক সকালে কথা হয় কুমড়ো বড়ির কারিগর শান্তি রানী দাসের সঙ্গে। তিনি জানান, ডাল ভিজিয়ে পাটায় মিহি করে বেটে বেসন বানান। তার সঙ্গে চালকুমড়ো বাটা মিশিয়ে বড়ি তৈরি করা হয়। বড়ি তৈরি করতে করতে ভোর হয়ে যায়। রাত পোহালে কুমড়ো বড়ি কড়া রোদে শুকোতে দেন। তারপর বড়ি শুকালে স্বামী শম্ভুনাথ দাস  বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। প্রতিদিন ১০-১৫ কেজি বড়ি বিক্রি হয়। কঠোর শ্রমের এই কুমড়ো বড়ি বেচে তারা এখন অনেকটা স্বাবলম্বী। সংসারে অভাব নেই। এটা করেই তার ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছেলে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। মেয়ে এখন স্নাতক পড়ছে। আগে সরকারি খাস জমিতে বসবাস ছিল। এখন নিজের কেনা জমিতে দুটি টিনের ঘর তুলে বাড়ি করেছেন।

এ গ্রামে শান্তি রানীর মতো প্রায় ৫০টি পরিবার কুমড়ো বড়ির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কথা হয় বৃদ্ধা মনোরমা পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার মাকে বড়ি বানিয়ে বেচতে দেখেছি। তখন চার আনা সের খেসারি ডাল ছিল। বড়ি বিক্রি হতো বারো আনা সের। তিনি বলেন, এই বড়ি বেচে আমি ৩ ছেলে ২ মেয়েকে মানুষ করেছি। ২ মেয়েকে এইচএসসি পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। ৩ ছেলে এখন মিষ্টির ব্যবসা করে। প্রদীপ ভৌমিক বলেন, এক কেজি বড়ি বানাতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩৪ টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ৪৫-৫০ টাকা। খুচরা বিক্রি হয় হাটে-বাজারে ৬০ টাকা। তিনি বলেন, আমরা খুচরাই বেশি বিক্রি করি। তাতে লাভ বেশি থাকে।

মনোরমা পালের নাতনি কলেজছাত্রী সরস্বতী রানী পাল জানায়, এই কুমড়ো বড়ি বানানো, শুকানোসহ সব কাজ মেয়েরা করে। আর ডাল পাটায় বেটে বেসন না করলে এ বড়ি হয় না। মেশিনে এ বড়ি হয় না। আদরী রানী ভৌমিক  বলেন, বড় মেয়েকে এইচএসসি পাস করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এই বড়ির ব্যবসা করেই জমি কিনে সেখানে আধাপাকা দুটি ঘর করেছি। বাবার বাড়িতেও জমি কিনেছি। বিজলী রানী  বলেন, ইডা ছোট ব্যবসা হলিও লাভ অনেক। তবে পরিশ্রম বেশি। আমরা ইডা করে উন্নতি করতিছি। ভালোই চলে। মাছ-ভাত খাই। তার দুই ছেলে উৎপল নবম শ্রেণীতে ও সুফল চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে। সুফল জানায়, ছুটির দিনে সে পাশের বাজারে বড়ি বিক্রি করতে নিয়ে যায়। সোনা ভৌমিক  বলেন, এই গ্রামের যোগেন ঘোষের বউ প্রথম কুমড়ো বড়ি বানান। সে অনেক বছর আগের কথা। তিনি বিক্রি করতেন না। আমার বড়মা বীণাপাণি স্বামীর মৃত্যুর পরে এই বড়ি বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন প্রথম। ৪০ বছর তিনি বড়ি বানিয়েছেন।

বেলা রানী ভৌমিক বলেন, এখানে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে ২৫ বছর বড়ি বানাচ্ছি। এটাই আমাদের জীবিকা। তার ২ ছেলে ২ মেয়ে। এক মেয়েকে এইচএসসি পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। আরেকটা শিপ্রা রানী এইচএসসি পাস করে কম্পিউটার শিখছে। এক ছেলে সোনার কাজ করে, ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। বেলা রানী বলেন, আগে দেবরের বাড়িতে থাকতেন। ৩ বছর হলো জমি কিনে বাড়ি করেছি। দুটে টিনের ঘর দিছি। নিখিল চন্দ্র দাস বলেন, ১৮ বছর কুমড়ো বড়ির ব্যবসা করতেছি। দুই ভাই মিলে দিনে ১০০ কেজি বড়ি বানিয়ে বিক্রি করি। ৭ বছর ভাড়া বাড়িতে বাস করেছি। অল্পদিন হয় জমি কিনে টিনের ঘর দিছি।

শম্ভুনাথ দাস বলেন, আগে সব ডালের বড়ি বানানো হতো। ডালের দাম বেশি হওয়ায় এখন শুধু অ্যাঙ্কর ডালের বড়ি বানানো হয়। তিনি বলেন, এটা ৭ মাসের ব্যবসা। বাংলা ভাদ্র থেকে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাসে গিয়ে শেষ হয়। বাকি সময় আমরা অন্য কাজও করি। মনোরমা পাল বলেন, ডাল পরিষ্কার করে ধুয়ে ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর পাটায় বেলা বাটতে হয়। হাত দিয়ে ফেনানোর পর কলীজিরা, সাদা জিরা ও গুয়ামহুরি দিয়ে সকালে বড়ি বানিয়ে টিনের পাতে রোদে শুকাতে হয়। সোনা ভৌমিক বলেন, আবহাওয়া খারাপ হলে বড়ি শুকানো যায় না। তখন ডাল গরুকে খাওয়াতে হয়। প্রায় দু’দিন লাগে বড়ি শুকিয়ে বিক্রি উপযোগী করতে।

এ গ্রামের বাসিন্দা ভাষাসৈনিক ও আইনজীবী গৌরচন্দ্র সরকার বলেন, চলনবিলের মিঠাপানির রকমারি সুস্বাদু মাছের সঙ্গে তরকারি হিসেবে কুমড়ো বড়ির তুলনা নেই। এক সময় বউ-ঝিরা বাড়িতে শখ করে বড়ি বানাতেন। আর এখন এটা এ গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবারের প্রধান জীবিকা। এ গ্রামের আরেক বাসিন্দা পৌরসভার কাউন্সিলর খয়বর হোসেন বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে বড়ি বানানো দেখছি। এই ব্যবসা করে ওরা সবাই সংসারে সচ্ছলতা এনেছে।

 
 
 
পাবনা নিউজ২৪.কম
থানাপাড়া (হেলেন কটেজ), পাবনা-৬৬০০
ই-মেইলঃ newsroom@pabnanews24.com