১৭ আষাঢ় ১৪৩১
 

সর্বশেষ

ঈশ্বরদীর লায়লাতুল ফেরদৌস গরু মোটাতাজাকরণ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে

Dec 26, 2013, 12:04:35 AM

ঈশ্বরদীর লায়লাতুল ফেরদৌস গরু মোটাতাজাকরণ করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে

সেলিম আহমেদ : গ্রাম্য বধু লায়লাতুল ফেরদৌস (পাতা) চার দেয়ালের গন্ডির মধ্যে যার নিরিবিলি জীবন-যাপন করার কথা-তিনি আজ রীতিমত একজন সমাজ উন্নয়ন কর্মীর দায়িত্ব পালন করছেন। বসত বাড়ির আশপাশে নিবিড় সবজি চাষ এবং গরু মোটাতাজা করণ করে এলাকাবাসীকে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সেবাদানকারী সমিতির ক্ষুদ্রদলের গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভানেত্রী লায়লাতুল ফেরদৌস পাতার স্বামী আকুব্বর আলী একজন শ্রমিক। দাশুড়িয়ার একটি রাইস মিলের ড্রাইভার হিসেবে বর্তমানে কাজ করেন। দুই সন্তানের জনক-জননী আকুব্বর-পাতা। ছোট এই সংসার তাদের বেশ স্বাচ্ছন্দে চলে যায়। 

লায়লাতুল ফেরদৌস জানান, স্বামী কাজে বেড়িয়ে গেলে একদম অলস বসে থাকা তার ভালো লাগতোনা। বসতবাড়ির আশপাশে শাক-সবজির চাষ শুরু করেন। এর পর আর থেমে থাকেনি লায়লাতুল ফেরদৌস। লালশাক, পুঁইশাক, বেগুন, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ, যা কিছু তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করেন তা দিয়েই সারা বছরের সবজির চাহিদা মিটে যায়। এমনকি বাড়তি কিছু আয়ও হয়। ২০১০ সালে ঈশ্বরদী উপজেলা সেবাদানকারী সমিতির সাধারন সম্পাদক সাবান আলী লোকাল সার্ভিস প্রোভাইডার (এলএসপি)’র মাধ্যমে গুরু মোটাতাজা করণ প্রশিক্ষণ নেন ২৫ সদস্যের একটি দলে। সমিতি গঠনের আগে বিচ্ছিন্ন ভাবে তারা গরু পালন করতেন। তখন গরু পালন করে তাদের তেমন একটা লাভ হতোনা। বর্তমানে সমিতি গঠনের পর থেকে এলএসপিদের পরামর্শে গরু ক্রয় করে পালন এবং সঠিক ভাবে গরুকে খাদ্য দেয়ার ফলে তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই গরু মোটাতাজা হয়ে যায়। এরপর ওই গরু বিক্রি করে বর্তমানে তারা লাভবান হচ্ছেন। সমিতি গঠনের পর থেকে এখন তাদের পালিত গরু বিক্রি করতেও কোন সমস্যা হয়না। ব্যাপারীরা বাড়ি বাড়ি এসে গরু কিনে নিয়ে যায়। 

লায়লাতুল ফেরদৌস বলেন, একমাত্র স্বামীর রোজগারের টাকায় সংসার চালানো খুব কষ্টের ছিল। এক সময় তাদের তিন বেলা ঠিক ভাবে খাবার জুটতোনা। অনেক সময় আধা পেটা খেয়ে থাকতে হতো। মাঝে মধ্যে উপোষও থাকতে হয়েছে তাদের। স্বামী আকুব্বর যখন মাঠে অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতো তখন কাজ না থাকলে এই অবস্থা হতো বলে তিনি জানান। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে অবস্থা খুবই খারাপ হতো। তিন বেলা ঠিক ভাবে খাবার জুটতোনা ছেলে-মেয়েদের কিভাবে স্কুলে পাঠবো। ভেবেছিলাম হয়তো ছেলে-মেয়ে দুটিকে স্কুলে পাঠাতে পরবোনা। সেবাদানকারী সমিতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ধার দেনা করে একটা গরু কিনে গরু মোটতাজাকরণ পদ্ধতিতে পালন করতে থাকি। সেই গরু হাটে বিক্রি করার পর বেশ কয়েক হাজার টাকা লাভ হয়। সেই থেকে খুলতে থাকে আমার ভাগ্যের চাকা। স্বামী এখন ধানের মিলে ড্রাইভারী করেন। আর আমি গরু পালন নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এখন আমরা এক সাথে দুজনই আয় করছি। এক ছেলে এক মেয়ের সংসার বেশ ভালো ভাবেই চলছে। লায়লাতুল ফেরদৌস জানান, মাত্র ৫ কাঠা জমিতেই বসবাস এবং শাক সবজির আবাদ করতেন। গরু মোটাতাজাকরণ করে বর্তমানে ৬ বিঘা জমি কট নিয়ে সেখানে ধান, রবি শস্য, সবজি চাষাবাদ করছেন। বর্তমানে এই খামার থেকে বছরে এক লাখ টাকার বেশি আয় হচ্ছে। সহজ শর্তে এবং কম সুদে সরকারি বে-সরকারি সংস্থার কাছ থেকে ঋণের সুবিধা পেলে লায়লাতুল ফেরদৌস তার আবাদি জমির পরিমাণ এবং গরু মোটাতাজকরণ বাড়াবেন। ঘরের গৃহীনি থেকে লায়লাতুল ফেরদৌস এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ও নারী কৃষক। 

ঈশ্বরদী উপজেলা সেবাদানকারী সমিতির সাধারন সম্পাদক সাবান আলী (এলএসপি) জানান, সেবাদানকারী সমিতির ঈশ্বরদী (এসপিএ) থেকে ২৫ জন সদস্যকে গরু মোটাতাজা করণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেই সঙ্গে গরু নির্বাচন, খাদ্য পরিবেশন, বাসস্থান, চিকিৎসা ভেকসিন, ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন লোকাল সার্ভিস প্রোভাইডাররা। মূলাসেচ, দানাদার খাবার, কাঁচা ঘাস, খড় খাওয়ানের কারণে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে গরু মোটাতাজা হয়ে যায়। এরপর তারা গরু বিক্রি করে দেন। এই পদ্ধতিতে গরু পালন করলে খরচ কম হয় এবং অল্প সময়ে গরু বিক্রি করে মূনাফা বেশি পাওয়া যায়। এসডিসি সমিতি প্রকল্প রাজশাহী অঞ্চল হেলভেটাস সুইস ইন্টারকোঅপারেশন এর সহযোগী সমন্বকারী নুরুল ইসলাম লায়লাতুল ফেরদৌসের গরু মোটাতাজকরণ পদ্ধতি পরিদর্শনে এসে বলেন, আমাদের প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের স্থায়িত্বশীল জীবন মানের উন্নয়নে অবদান রাখা। ঈশ্বরদী উপজেলায় এসপিএ-এর মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র ও অতিদরিদ্র কৃষকের দোরগোড়ায় কৃষি সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সৃমদ্ধি প্রকল্প গরু মোটাতাজাকরণ বাজারের উল্লেখিত সার্বিক বাধা সমূহ উত্তোরণে বাজার উন্নয়নের ধারাবাহিক পদ্ধতিতে (ভেল্যূ চেইন উন্নয়ন) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করে আসছে। বর্তমানে এসব সংগঠন সমূহের উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় গন্ডি পেরিয়ে আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ের বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আর এ কারণে তাদের উৎপাদিত গরু মোটাতাজাকরণ পণ্য বিক্রির জন্য বৃহৎ আকারের ক্রেতা ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়েছে। ঈশ্বরদীর লায়লাতুল ফেরদৌস গরু মোটাতাজকরণ পদ্ধতিতে গরু পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার দেখা দেখি ওই এলাকার অনেক নারী এখন গরু মোটাতাজাকরণ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। 

ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিন বলেন, লায়লাতুল ফেরদৌস গরু মোটাতাজকরণ পদ্ধতিতে গরু পালন করে সে এখন ঈশ্বরদীর একজন মডেল কৃষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, মুলাডুলি ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের দরিদ্র ও হতদরিদ্র নারীরা গরু পালন করে এখন তারা স্বাবলম্বী। তারা তিন বেলা ঠিক ভাবে খেতে পড়তে পারছেন। গরু বিক্রি করতে তাদের বেগ পেতে হয়না। ব্যাপারীরা তাদের গ্রামে গিয়েই গরু কিনে আনেন। লায়লাতুল ফেরদৌসের দেখা দেখি ওই এলাকার মহিলাদের মধ্যে গরু পালনের প্রতিযোগীতা চলে এসেছে। লায়লাতুল ফেরদৌস এভাবে তার প্রজেক্ট ধরে রাখতে পারলে এক সময় আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবেন বলে আমি ধারণা করছি। 

 
 
 
পাবনা নিউজ২৪.কম
থানাপাড়া (হেলেন কটেজ), পাবনা-৬৬০০
ই-মেইলঃ newsroom@pabnanews24.com